আমার ব্রহ্মচর্য জীবন শুরুর আগের ঘটনা.. আশ্রমে আসা যাওয়া করছি, মহারাজের কথা মত 'সাধুকে দিনে দেখবে, রাতে দেখবে'-র পর্ব জীবনে তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। উপনিষদের ক্লাসে নিয়মিত যাচ্ছি, প্রশ্নবাণে মহারাজকে জর্জরিত করছি.. যদিও তখনও নামের সাথে 'প্রশ্ন বিচিত্রা' উপাধিটি সংযোজিত হয়নি।
এমতাবস্থায় একদিন ক্লাসের পর বৈঠকখানায় বসে মহারাজ আমাদের সাথে নানান বিষয়ে কথা বলছেন। মহারাজ তাঁর জীবনের নানান বিচিত্র মজার ঘটনা বলছেন। কিন্তু এবার তিনি যা বললেন, তা শুনে উপস্থিত সকলেই চুপ করে গেলেন। রাগে আমার চোখ যেন জ্বলে উঠল। মহারাজ সহাস্য বদনে বলে চলেছেন....
আমি যখন অমুক মঠে ছিলুম, তখন বড্ড বেড়ালের উৎপাত ছিল সেখানে। এদিকে আমরা সব প্রার্থনায় বসেছি, কি ধরো কোন একটা অনুষ্ঠান চলছে, পূজো চলছে.. আর অমনি বেড়ালগুলো এক তাল হেগে চাতালময় করেছে। গু এর গন্ধে টেকা দায়! পূজো হবে কি! সকলে নাকে হাত চাপা দিয়ে বসে।
আমি বললাম, কি করলেন তারপর!
মহারাজ: হাজার বার মহান্তকে জানানো হলো, নেটের ব্যবস্থা করতে বলা হলো, ঝামেলায় অবধি গড়ালো বিষয়, কিন্তু কাজের কাজ লবডঙ্কা হল! কারণ এই বেড়ালগুলো পোষা। বংশ পরম্পরায় তাদের এখানেই আস্তানা। তাই লুচুপুচুরা যতই জ্বালাতন করুক, খেতে তো ওদের অন্দরমহলেই দেওয়া হবে। বাইরে খাওয়ানো মানা।
পরিস্থিতি হাতের নাগালে না আসায় শেষ রাতে সত্যি সত্যি বেড়াল আমাকেই মারতে হল। এক কাপ গরম চা দিলাম ঢেলে, বেড়াল বাবাজীবনরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেল। মহাশয় খুব জব্দ হলেন বটে, তবে মুখে আর কিচ্ছুটি বললেন না। সকলে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিতে লাগলো, যে অবশেষে এতদিন পর তাঁরা প্রাণ ভরে সাধন ভজনে মন দিতে পারবে।
কথা শেষ হতেই দেখলাম সক্কলে চুপ। বুঝলাম, একটি অবলার এমন দুর্দশা স্বয়ং মহারাজ করেছেন, এটা মানতে হয়তো সভার সকলেরই খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে মহারাজ বলে কথা! মুখের ওপর ভালো মন্দ কিছু কি বলা চলে! তাই তারা মৌন হয়েই প্রতিবাদ জানালেন।
আমি কোনোকালেই এই চুপ হয়ে বসে থাকা মানুষের দলের নই, মুখের ওপর জবাব দেওয়ার দুঃসাহসের জন্য জীবনে ঝামেলাও তাই পুইয়েছি বিস্তর! সেখানে মহারাজ তো স্বয়ং আমাদের প্রশ্ন করতে শেখান।
সটাং বললাম, 'আপনি কি মনে করেন, একটি অবলা প্রাণীকে মারার কাজটা করে আপনি খুব ভালো করেছেন?'
মহারাজ উত্তরে অতি শান্ত ও নম্র গলায় আমায় নানান ভাবে বোঝাতে শুরু করলেন যে তিনি সত্যিই সেদিন নিরুপায় ছিলেন। কিন্তু বোঝবার মতন মনের অবস্থা আমার তখন একেবারেই ছিল না। কারণ আমি নিরপেক্ষ ছিলাম না। ছোট থেকেই কুকুর বিড়াল এদেরই অতি আপনার বলে জেনেছি। বন্ধু বান্ধব বিশেষ একটা ছিল না। খেলাধূলার সঙ্গীও ছিল এরাই। এদের গায়ে একটা আঁচড়, তাই আমাকে উন্মত্ত করতে যথেষ্ট! আর সেখানে যাঁকে এত শ্রদ্ধা করি, শেষে কিনা তিনিই! রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে আমি ফুঁসতে থাকলাম।
সেদিন বাড়ি ফেরার পর গোটা রাত ঘুমাতে পারলাম না ঠিক ভাবে, সারা রাত বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলাম। মাঝে মাঝে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরময় পায়চারি করতে করতে ভাবতে থাকলাম, কিভাবে সম্ভব এটা! ওনাকে যত দেখেছি, কোথাও যেন একটা গভীর প্রেম অনুভব করেছি বারবার! এমনকি ওনার বকা ঝকার মধ্যেও তাইই যেন প্রকাশ পায় বলে মনে হয়েছে বারবার.. তবে কি আমার কোথাও কোনো বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে? আমি কি এই আশ্রমে থাকবার কথা ভেবে সিদ্ধান্তে ভুল করলাম?
সেই রাতটা আমার সত্যিই বড় অস্বস্তিতে কেটেছিল। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না বিষয়টা। ভোরের দিকটায় আর শরীর দিচ্ছিল না, ক্লান্ত লাগছিল ভীষণ। ইষ্টদেবকে স্মরণ করে বললাম, তুমিই পথ দেখাও, আমি বুঝতে অক্ষম!
তারপর, শুয়ে পড়লাম..
ঘুম থেকে উঠতেই ফ্ল্যাশ ব্যাকে মহারাজের কথা গুলো মনে পড়তে লাগলো, সাথে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী ভগবান শ্রী কৃষ্ণকেও যেন স্পষ্ট দেখলাম। যিনি আমাদের সাধারণ চোখে চূড়ান্ত বড়ো গেম প্লান্যার, বৃন্দাবনের গোপীদের ক্যারেক্টরলেস প্রেমিক, যিনি রাধা তথা যশোদা-দেবকীর গোটা জীবনের অশ্রুপাতের কারণ!
মনে প্রশ্ন এলো, এতো সব করেও তিনি ভোগবান না হয়ে ভগবান কেন? উত্তর পেলাম, কারণ উনি বোধে বাঁচতেন। যা সাধারণের চোখে অত্যন্ত গর্হিত কাজ, বোধবান ব্যক্তির জন্য তাইই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো তাঁরা ভালো মন্দের থেকে অনেক উপরে উঠে জীবন বাঁচেন।
এইভাবে একটার পর একটা পাল্টা প্রশ্ন আমার মনের সমস্ত অন্ধকার দূর করে আলো এনে দিল।
বুঝতে পারলাম এক অবলাকে কষ্ট দেওয়া সাধারণ ক্ষেত্রে অপরাধ তো বটেই, তবে এই অপরাধও ধর্ম হয়ে যায়, যখন সামনে তার চেয়েও অনেক অনেক উঁচু কোন লক্ষ্য এই কাজই দাবি করে পরিস্থিতির সাপেক্ষে।
যেমন কোন এক রামচন্দ্রকে লুকিয়ে বিনা অপরাধে বালি রাজকে মারতে হয় কিংবা শ্রীকৃষ্ণকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নিরপরাধীর মৃত্যু দেখতে হয় পুনঃ পুনঃ ধর্ম সংস্থাপনের অভিলাষে.. তেমনি কোন এক সন্ন্যাসীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের হাতে কিছু অবলাকে কষ্ট দিতে হয়, যাতে চেতনার দাবিতে কিছু মুমুক্ষুর সাধন চলতে পারে অবিলম্বে।
রামচন্দ্রকে এই মৃত্যুর দায়ভার নিতে হয়েছিল পরজন্মেও, শ্রীকৃষ্ণ সহাস্য বদনে স্বীকার করে নিয়েছিলেন মাতা গান্ধারীর দেওয়া অভিশাপ, যেমনটি মহারাজ পারেন জনসমক্ষে তাঁর এই কৃতকার্য অবলীলায় স্বীকার করে নিতে, এ কথা জানা সত্ত্বেও যে আমার মত কিছু মূর্খের দল তাঁর এই কাজের পেছনের সত্যতা যাচাই না করেই চিরটা কাল তাঁকে গালমন্দ করে যাবে!
আজ মহারাজের একটা কথা খুব মনে পড়ছে.. পূর্ণতা নিরাকার, পূর্ণ হলে দেহ ধারণ করবে কে? তাই এ জগতে কেউই পূর্ণ নয়। তবু সঠিক কর্ম করে এগিয়ে যাওয়াই কর্তব্য