মহারাজ যে আমাদের কত বড়ো হিতৈষী তা লক্ষ কোটি বার চিৎকার করে বলে ফেললেও অনেক কম বলা হয়।
তবে এ কথা খাঁটি সত্য যে আমাদের মঙ্গলার্থে তাঁকে বহু সময় কঠিন হতে হয়, আমাদের মধ্যে অনুশাসনের বীজ বপন করতে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ভয় পেয়ে যাই, যখন মহারাজ একেবারে চুপ হয়ে যান! বড্ড খালি খালি লাগে, মনে হয় মাথার ওপরে যে আশীর্বাদের হাতটা ছিল, তা যেন হঠাৎ সরে গেছে।
আজকের যে ঘটনাটির কথা আমি লিখতে চলেছি, তা এক সময় এমনই শূন্যতায় ভরিয়ে দিয়েছিল
আমায়।
ছোটবেলায় বন্ধু বলতে যা বোঝায়, আমার তা বিশেষ একটা ছিল না। প্রকৃতি, অবলা এবং গল্পের বই... এদেরই সঙ্গ আমার একাকীত্বকে দূর করতে যথেষ্ট ছিল।
কুকুর প্রজাতিটি বরাবরই তাই মনের বড়ো কাছের। এই প্রাণীটির চোখ দুটির মধ্যে এমন বিশেষ কিছু আছে, যা আমায় বারবার টানে।
আর এই বিশেষ মানেই যে বন্ধন, সে ভালো হোক বা মন্দ, তা বলে দেবার মত এক সময় জীবনে কেউ ছিল না। তাই বোধের অভাবে এই প্রজাতির জন্য পাগলামির যেই স্তর অবধি যাওয়া সম্ভব, তার শেষ সীমায় আমি অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছি।
এখানে আসার পরও আমি এই বন্ধনকে পুরোপুরি কাটবার প্রয়োজন কক্ষণো অনুভব করিনি অন্তর থেকে। প্রয়োজন সেদিন বোধ হল যেদিন একটা সপাটে চড় পড়েছিল গালে, মহারাজের কথায়!
শেওড়াফুলি থেকে দিয়াড়া আসা যাওয়ার পথে অনেক কুকুরকে প্রায়শই দেখা যায় রাস্তায় আর ওদের দেখলেই পূর্ব সংস্কার অনুযায়ী মনে হত, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, একটু গালটা ধরে টানি ইত্যাদি ইত্যাদি। এর পুঙ্খোনাপুঙ্খ বাস্তবায়নও ঘটিয়েছি বহুবার। একবার এক আশ্রামিক এই কথা মহারাজের কানে তুললেন আমারই মঙ্গল কামনায়।
এখন মনে পড়ে সেই দিনটা, মহারাজ সবে খেতে বসেছেন তখন।
সব শুনে, খেতে খেতেই বললেন, ছোট বেলায় খুব বাংলা সিরিয়াল দেখতে নাকি? কুকুরের কোন প্রয়োজন নেই তোমার এইসব আদরের, যদি সত্যিই ভালোবাসো ওদের দুটো করে খেতে দাও। আমি তোমার পূর্ণ সমর্থন করব। আমি টাকা দেব, তুমি ওদের খাওয়াও।
কিন্তু তুমি যদি রাস্তায় ওদের জড়িয়ে আদর করো, চুমু খাও, পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার মনে হবে গালটা যদি তার হত। তোমার চামড়ার প্রতি টান এর জন্য তুমি ওদের কেন টানাটানি করবে!
কথা গুলো বড্ড বেজেছিল কানে। দুর্বল হয়েছিল মন। ভাষা নেই আমার সেই মুহূর্তকে ব্যক্ত করার। শুধু এটুকু বলতে পারি অহংকার চরমে উঠে বলেছিল, ' কিছু না জেনে, না বুঝে, এভাবে বললেন কি করে আমায়! ' তবে কথাগুলো লজিকে কাটা আমার পক্ষে ঠিক সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বললাম, ঠিক আছে, আমি আর আজকের পর থেকে ওদের ছুঁয়েও দেখবো না!'
কিন্তু মন যদি এমনই সোজা হত, তবে আর ভাবনা ছিল কিসের! বিশেষত, নারী চরিত্রকে প্রকৃতি এমন সৃষ্টিই করেননি, যে তারা চাইলেও তাদের মন মুখ এক হয়।
অকাট্য যুক্তিতে সব কথা মেনে নিলেও মাথায় বারবার বাংলা সিরিয়ালের কথাটা ঘুরতে লাগলো।সময় বাড়তে লাগলো, ভেতর জ্বলতে থাকলো দাউ দাউ করে।
শেষে অবস্থা এমন হল যে, গুরু শিষ্যের শিষ্টতাটুকু মাথায় রাখা সম্ভব হল না আর। খুব দ্রুতগতিতে একটা মেসেজ টাইপ করলাম।
যার ভাব অনেকটা এমন... আপনি জানেন কত টুকু আমাকে? আমি এমন ভন্ড সমাজকে মানি না, যাদের কথা আর কাজে কোন মিল থাকে না!
এই সমাজের তোয়াক্কা করে চলতে হবে আমায়? আত্মায় তো কোন নারী পুরুষ নেই, তবে মেয়ে বলে কেন আমাকে আমার পছন্দ অপছন্দ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে?
আপনি আমার গুরু, তাই আপনার কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। কিন্তু আমি কক্ষনো এমন মিথ্যা সমাজকে মন থেকে মানি না! ক্ষমা করবেন।
কিছুক্ষণ পর মহারাজের রিপ্লাই...
আজ থেকে আমি আর কখনও তোমায় কোন প্রাক্টিক্যাল সাজেশন দেব না। তিনি তোমার মঙ্গল করুন।
কথা গুলো পড়ে যেন আরো দাউ দাউ করে জ্বলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু অহংকার হার মানতে জানে কি?
সে তার চেয়ে ঠিক কাউকে কখনো জানতে পারে কি?
কক্ষনো নয়। অহংকারের কালো মেঘ সত্যের নির্মল আকাশকে বারে বারে ঢেকে দিতে জানে শুধু। তাই মেসেজ করলাম, যেমন আপনার ইচ্ছা, প্রণাম।
এরপরে অনেকগুলো দিন কেটে যায়..
নাহ্! কখনো কোন দুর্ব্যবহার না পেলেও মহারাজের নিশ্চুপতা আমায় বারবার মনে করিয়ে দিত যে কত দূরে সরে গেছি আমি সেই স্নেহের ছায়াতল থেকে। একটা কাঁটা সর্বক্ষণ বুকে বিঁধে রইল।
কিন্তু আমি কে? আমি অহংকারী!
সত্যিকে দুমড়ানো মুচড়ানো আমার কাজ, সহজকে জটিল করাই আমার কাজ! তাইই বারবার আঘাত করি সেই গুরুতাকে যাঁর চেয়ে বড় হিতৈষী এই গোটা পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারেনি কখনো।
এই সময়টা সব থেকেও আমার দম বন্ধ লাগতো, মনে হত পালিয়ে যাই দূরে কোথাও। মহারাজকে দেখতাম আমার ভুলগুলি আমাকে সরাসরি বলা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন।
এই সময় কেউ একজন ভেতর থেকে বারবার বলতো ধৈর্য্য.. সময় ঠিক ভুল সব বলে দেবে।
এর অনেক পর একদিন একটি লেকচারের ক্লাসে নিজেকে মেলাতে গিয়ে খেই হারালাম। মনে হল গন্ডগোল হচ্ছে না তো!
সব অহংকারকে দুমরিয়ে মহারাজকে মেসেজ করলাম, আমি ভন্ড বা কপট হতে চাই না। আপনি আমায় সত্যি বলুন।
সেদিন আমায় মহারাজ সংযমের মন্ত্র শিখিয়ে ছিলেন, যাকে আমার অকর্মণ্যতার জন্য জীবনে ঢালতে গিয়ে পদে পদে ধাক্কা খাই। উনি সেদিন বলছিলেন কুকুরকে আদর করায় কোন দোষ নেই। কিন্তু প্রকৃতিতে শক্তির জয় সর্বত্র। শক্তিহীনকে পিষে দিতে সমাজ সবসময় প্রস্তুত। এখানে জঙ্গলরাজ, ন্যায় নীতির জায়গা নয় এটা । মেয়েদের এখানে ভোগ্য এবং দূর্বল মনে করা হয়। যদি আমার শারীরিক দূর্বলতা কাটিয়ে আমি আমার পছন্দকে প্রাধান্য দিই, তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু যতক্ষণ আমার muscle এ সেই শক্তি নেই, যাতে আমি দুটো প্রাপ্তব়স্ক পুরুষকে আছাড় মারতে পারি, ততক্ষণ ব্রহ্মচারিণী হিসাবে কিছু সংযম আমার প্রয়োজন।
নয়তো সমাজ আমায় মেনে নেবে না, আর আমায় পরার্থে কাজ করবার সদিচ্ছা ত্যাগ করতে হবে।
সেদিন তাঁর কৃপা, আমায় অহংকারের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল। যে আত্মায় লিঙ্গ ভেদ না থাকার তত্ত্বের দোহাই আমি আমার সুবিধার জন্য ব্যক্তিগত ভালোলাগার প্রাধান্য রক্ষার্থে দিয়েছিলাম, তা যে আমায় আত্মায় নয় অনাত্মা তথা অবিদ্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত গতিতে,তা সেদিন না বুঝলেও, আজ আমি স্পষ্ট বুঝি।
মুখে খানিক লেকচার দেওয়া বড্ড সহজ, কিন্তু এর আচরণ ঠিক ততই শক্তি দাবি করে প্রতি মুহূর্তে আর শাস্ত্রকে পড়ে নিয়ে পণ্ডিত হওয়া যত সহজ, একে জীবনে ঢেলে জ্বলে পুড়ে নিজেকে নিজেরই হাতে প্রতি মুহূর্তে শেষ করতে জীবন অনেক সাহসের দাবি রাখে। এমন বুকের পাটা কোথায়? তাই জন্যই বারবার সুবিধা এসে গ্রাস করে আর অহংকার সুযোগ বুঝে আগুন জ্বালায় অন্তরে।
আর তখনই প্রয়োজন পড়ে গুরুতার, যা প্রথম আঘাতে জ্বালা আরও কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই আঘাতই ভেঙে চুরমার করে মিথ্যে অজ্ঞানতার প্রাচীর। আর তখন সেই একই শব্দ অন্তরকে এক অপার্থিব শীতলতায় ভরিয়ে দেয়, জন্ম দেয় এমন এক আনন্দের, যা মুখে বলা যায় না।
মহারাজ বলেন, গুরু তোমায় গড়তে নয়, ভাঙতে আসেন! অন্তর বলে, সত্যি, সত্যি, সত্যি..