....তবে কি ত্যাগই আসল ভোগ?
স্থান: অদ্বৈত জ্ঞান পীঠ আশ্রম, দিয়াড়া
তারিখ: ২.০২.২০২২
যে সকল কলাকৃতিতে মহারাজ বিশেষ ভাবে পারদর্শী, তারই মধ্যে অন্যতম হলো তাঁর সঙ্গীতচর্চা। অত্যন্ত সুমধুর স্বরে ভাবাবেগপূর্ণ হয়ে যখন তিনি কোনো রাগাশ্রয়ী বন্দেশ ধরেন, তখন মনে হয় গন্ধর্বলোক থেকে কোন এক অচিন গন্ধর্ব বীণাপাণির আরাধনায় যেন লীন হয়ে আছেন।
সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে এমন ভক্তিপূর্ণতা এবং প্রেমময়তার বারিধারা হয়তো কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন সাধক তাঁর সাধনার একেবারে শীর্ষে পৌঁছেছেন.. যখন তাঁর সমগ্র জীবনই সাধনায় রূপান্তরিত হয়।
যদিও এই অধমের জীবনে এমন দুঃসাহসের কোনো কারণ ঘটেনি যে সে স্বয়ং গুরুদেবের বিষয়ে একটি মাত্র শব্দ প্রকাশেরও নূন্যতম যোগ্যতা মাত্র রাখে.. তবুও সে এই ধৃষ্টতার সাহস এবং অনুপ্রেরণা পেয়েছে স্বয়ং তাঁর গুরুর থেকেই.. যিনি বলেন, ' আদর্শের জন্য সমর্পিত হও, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ো না।'
এমন শতসহস্র শিক্ষা তিনি অতি স্নেহ ভরে নিত্যদিন অকাতরে বর্ষণ করে চলেছেন। যদিও তার মর্মার্থ গ্রহণের যোগ্যতা শিষ্যের আদৌ আছে কিনা, তা কেবল তিনিই জানেন!
এমনই একটি ঘটনা, যা হাসতে হাসতে এক গভীর শিক্ষা দিয়ে যায় --- তা আজ পাঠকের সাথে ভাগ করে নিতে সাধ হচ্ছে।
সামনেই সরস্বতী পূজা। ঢের তোড়জোড় চলছে তাই আশ্রমে.. সেই সঙ্গে জোরকদমে চলছে গানের রিহার্সাল। অধিকাংশ গানই কারুর কারুর জন্য একবারে নতুন। তাই ভুল হচ্ছে, বার বার ভুল হচ্ছে.. আর প্রতিবারই মহারাজ স্নেহবশে সকলকে সেই ভুল ধরিয়ে দিয়ে আগের মতোই চর্চা অব্যাহত রাখছেন।
স্বামী প্রেমেশানন্দজীর লেখা ইমন কল্যাণের ওপর একটি বিখ্যাত গান ধরলেন মহারাজ, ' আবারও ভারতে ভারতীর বীণা...'। অদ্ভুত এই গান.. গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেনো এক গভীর তত্ত্ব... অথচ কত সরল করে বুঝিয়ে দিয়ে যায়।
সকলে গাইলো একসাথে। একসময় গান শেষ হলো। যেই ভাবসাগরে এতক্ষণ মজে ছিলেন মহারাজ, মনে হলো সেই অতি দূর সাগর থেকে তাঁর স্বর ভেসে আসছে। তিনি বলে চলেছেন... এগুলো শুধু গান নয় রে.. কি গভীর অর্থ দ্যাখ! 'আবার ভারতে'- শুধু এইটুকুর অর্থই কত গভীর।
এই ভারত ঋষির ভারত, আধ্যাত্মের core (মূল) সত্ত্বা এই ভারত। বুঝতে পারছিস কিছু? এবার এই লাইনটা দেখ.. 'অশ্রু সলিল সিক্ত, রিক্ত, দুরিত, পূরিত শোকেতে ম্লান, দৈন বেদনা আছে শুধু মাগো.. পূজা উপহার করিতে দান।' আহাঃ! কি অপূর্ব অভিব্যক্তি..
তোরা গান তো গেয়ে যাচ্ছিস.. কিন্তু একে ভোগ করছিস? দ্যাখ, অধ্যাত্মে না আছে কামের ভোগ আর না আছে নামের। ভোগ এগুলোই...
যখন বলছে 'আবার ভারতে..'... তখন এই আধ্যাত্মিক ভারতের গর্বে যেন তোদের বুক ফুলে ওঠে। যখন এই ' অশ্রু সজল..' জায়গাটা হচ্ছে তখন ভেতরের কান্নাটাকে অনুভব কর। আধ্যাত্মিক জীবনে এই গুলোই চরম ভোগ...
না এই জীবনে তোরা দেহ সঙ্গ পাচ্ছিস, না প্রচুর অর্থ পাচ্ছিস, আর না নাম যশ। তাহলে বাঁচবি কি নিয়ে? এগুলো যদি ভোগ না করতে পারিস, তবে জীবন শুকনো লাগবে! এই জীবন তখন continue করা খুব কঠিন হয়ে যায়।
এবার তুই সংসারে ভোগ খুঁজতে যাবি। দেখবি, সেখানে আগে থেকেই বাঘ সিংহ সব দাড়িয়ে আছে, লাইন দিয়ে! একটু বেফাঁস হয়েছিস কি গিলে খাবে!
কিন্তু এ এমন ভোগ যাতে কোন অশান্ততা নেই, যা তোদের ভেতর থেকে শান্ত করবে..
যদিও এই স্বাদ একদিনে আসে না। প্রথমে একটু কষ্ট করতে হয়। কিন্তু তারপর এমন আনন্দ মেলে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
তোরা কি ভাবিস, এই যে রাতের পর রাত আমি গীতা, উপনিষদ্ নিয়ে কাটিয়ে দিই, তা কি এমনি এমনি! আমি ভোগ করি, চরম ভোগ করি.. সেই ভোগ যা আত্মাকে শুধুই তৃপ্ত করে..
এই সুক্ষ্ম ভোগই তো আধ্যাত্মিকতার আসল মজা! যার জন্য সব ত্যাগ করা যায়... সঅঅঅব....