February 28, 2022 - BY Admin

প্রেম ভালো, মোহ নয়

প্রেম ভালো, মোহ নয়.....


স্থান: অদ্বৈত জ্ঞান পীঠ, দিয়াড়া

তারিখ: ১৮.০২.২০২২



অর্ণব... 

মহারাজের সাথে এই নামটি অত্যন্ত গভীরভাবে যুক্ত। মহারাজের জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতে, দুঃখে আনন্দে যে.. সকল সময় ছায়ার মতো তাঁর পাশে হেঁটে চলেছে, তার নাম অর্ণব।

অর্ণব এর সাথে মহারাজের সম্পর্ক কেমন, তা একটি বাক্যে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব। অর্ণবের ভাষায় বললে বলতে হয়, "আজ ৬ বছর ধরে মহারাজের সাথে ঘর করছি, ওনাকে চিনব না!"

সত্যিই, সকলের চেয়ে হয়তো একটু বেশিই চেনে সে মহারাজকে। মহারাজের মুখেও তেমনি বারবার তার নামটিই যেন না চাইতেও চলে আসে, দিনে সহস্রাধিক বার তিনি হাঁক দেন 'অর্ণওওওওওব!', ক্লাসে কিছু বোঝাতে গিয়ে প্রায়ই তিনি অর্ণবের প্রসঙ্গ এনে ভক্তগণকে নানান ব্যবহারিক উদাহরণ দেন। যেখানেই যান তিনি, সাথে অর্ণব এবং তার ময়ূরপঙ্খীটি সদা প্রস্তুত থাকে। মুখে না বললেও বেশ বোঝা যায়, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ--- আশ্রমের সকল কাজের ভার তার ওপর ছেড়ে মহারাজ অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকেন। কিন্তু মজার বিষয় এই যে, তাদের এমন মধুর সম্পর্কেও ভাব-আড়ি, আড়ি-ভাব নিত্যদিন লেগে থাকে। কেউ কাউকে ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতেও পারেন না, আবার একসাথে থাকলে শিশুদের মতন একে অন্যকে ধরাশায়ী করতেও ছাড়েন না।



তাঁদের এমন যুগলবন্দী দেখে, কোন কোন আশ্রমিক মজার ছলে অর্ণবকে মহারাজের সুগৃহিনী বলে ব্যঙ্গ করে! সত্যিই..  শুধুমাত্র একজন আশ্রমিক নয়, অর্ণবের গুণবলেই হয়তো সে মহারাজের এমন অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে উঠেছে। 



কিন্তু, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইনি কোন সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারী নন, গৃহী ভক্তও নন। বরং গৃহত্যাগী, সকলের এবং সর্বোপরি মহারাজের প্রিয় অশ্রমিক। আশ্রমের সকলের সাথে মিলেমিশে তিনি বহাল তবিয়তে থাকেন! কিন্তু তার সাজ-পোষাক এবং বাহ্যিক আবরণ দেখলে তাকে চট করে গৃহী ভাবাটা খুব সহজ হয়ে যায়!

অত্যন্ত স্বাধীনতাপ্রিয়, তাই অনেক ক্ষেত্রেই একগুঁয়েও বটে! সেই কারণেই, সে না চাইলে মহারাজও কখনো কখনো তাকে দিয়ে কোন কাজ জোর করে করাতে পারেন না!

এমন স্বাধীনচেতা অর্ণবের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া, আশ্রমে সর্বথা নিষিদ্ধ।



একথা হয়তো অনেকেরই জানা যে মহারাজ প্রয়োজন অনুসারে, সময় অনুসারে.. প্রেম পরবশ হয়ে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথা ভাঙতে সিদ্ধঃহস্ত! তাই অনেক ক্ষেত্রেই আশ্রমে বাহ্যিক আচার বিচারের চেয়েও আন্তরিক সৌন্দর্যের গুরুত্ব অনেক বেশি দেওয়া হয়!

নৈতিকতার উপরে আধ্যাত্মিকতাই স্বভাবত সর্বাগ্রে স্থান পায় এই আশ্রমে।

কিন্তু তার অর্থ একেবারেই এই নয় যে, সমস্ত নিয়ম নিষ্ঠাকে একেবারে নস্যাৎ করার পক্ষপাতী মহারাজ। কক্ষণো নয়! না তিনি প্রথাকে কামড়ে জীবন বাঁচার কথা বলেন আর না ধর্মনিরপেক্ষতা আড়ালে নিজেদের উন্মত্ত নৃত্যকে প্রশ্রয় দেওয়া পক্ষে তিনি!


 যদি মহারাজের কথার কেউ এমনতর অর্থ প্রস্তুত করে, তবে তার জন্য তা বিরাট ভুল হয়ে যাবে!

 

এই আশ্রমেও তাই অন্যান্য আশ্রমের মতই কিছু সাধারণ নিয়ম বর্তমান। ভোরবেলা মহারাজ সকলের আগে ঘুম থেকে ওঠেন, তারপর একে একে সব আশ্রমিকদের নিদ্রা ভঙ্গ হয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, জ্ঞানীর আচরণ যেমন হয়, বাকিরাও সেই পথ অনুসরণ করে। তাই তাঁর আচরণেও অনেকক্ষেত্রেই অনেক বেশি সংযম চোখে পড়ে। খুব ভুল না হলে হয়তো, এই কারণেই তিনি এই নিয়ম কানুনের বিষয়গুলিকে বিষয়ের যোগ্যতা অনুযায়ী মেপে মেপে তবে জীবনে সাথে যুক্ত করেন, এবং প্রয়োজনে সময় বিশেষে তার পরিবর্তনও  ঘটান।


কোন এক সকালের ঘটনা..

 অর্ণবের থমথমে মুখ, ready হচ্ছে কোথাও একটা বেরানোর জন্য! জানা গেল, কি যেন একটা কাজে বাইরে যাচ্ছে সে। হয়তো দুই দিন আর ফিরবে না..

কারণ কি.. কিছুই বোঝা গেল না! শুধু অর্ণব চলে যেতেই মহারাজের আচরণেও সেই সহজাত সদাহাস্য ভাবের পরিবর্তে কেমন একটা অতি গাম্ভীর্য ফুটে উঠল আজ।

 

বিকেল হতেই বিষয়টা সকলের কাছে জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল..

কোন কারণবশত মহারাজের সাথে অর্ণবের আবারও মনকষাকষি হয়েছে। তাই সে চলে গেছে!

 

অবাক হতে হলো দেখে যে, মহারাজ যেন আবার সেই পূর্বপরিচিত মেজাজে! যেন সমস্ত মেঘ কেটে গেছে হৃদয় আকাশ থেকে..

শিশুবৎ হাসিঠাট্টা করছেন। এদিকে তার সেই প্রিয় সন্তান অর্ণবের যে চিহ্নমাত্র নেই আশ্রমের কোথাও, তা যেন তিনি একেবারেই ভুলে গেছেন।

 

বাইরে থেকে দেখলে হয়তো এই ভুল হওয়া খুব সম্ভব যে মহারাজ নির্দয়, নিষ্ঠুর!

কিন্তু আশ্রমিকরা ভালোই জানে, তিনি সদাপ্রেমময় বটে, তবে মোহগ্রস্ত নন কখনোই!

এমনকি যাকে তিনি সর্বাধিক বিশেষ আসন দিয়ে রেখেছেন তাঁর হৃদ মাঝারে, তার ক্ষেত্রেও তিনি এমনতর ভুল কদাপি করেন না।


পরের দিন সকালে ঘটনার কারণ জানা গেল... 

প্রায় সমস্ত কাজ ঠিক ঠিক করলেও অর্ণবের একটি বদ্ গুণ আছে, প্রত্যেক মানুষ বিশেষেই যেমন থাকে। সে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। এর আগে বহুবার মহারাজ তাকে সাবধান করেছেন, কিন্তু এবার হয়তো বকার মাত্রা একটু বেশিই ছিল।


দুদিন পর অর্ণবের আশ্রমে ফিরে আসার পর মহারাজের সাথে তার কথোপকথনের কিছু বিশেষ অংশ..


মহারাজ: তুই ঘুম থেকে ভোর পাঁচটায় ওঠ্ কিংবা বেলা বারোটায় ওঠ্ -আমার তা নিয়ে কোন বিশেষ মাথা ব্যথা নেই, কিন্তু তুই ঘুম থেকে ওঠার পর কি করছিস তাইই ঠিক করে দেবে তোর ঘুম থেকে কখন ওঠা উচিত! তাই সেই বিষয়ে আমার চিন্তা অবশ্যই আছে..


 ঘুম থেকে বেলা দেড়টায় উঠে, তুই যদি সারাদিন ব্রহ্মলীন হয়ে বসে থাকিস, যোগবাশিষ্ঠ, গীতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারিস তবে তোর জন্য কখনোই আশ্রম এর কোন নিয়ম নয়। তুই মুক্ত..

 


কিন্তু যদি এমন হয় যে, ঘুম থেকে উঠেই তোকে খাবার জন্য রান্নাঘরে ঘুরঘুর করতে হয়.. তবে তোর ক্ষেত্রে এসব নিয়মকানুনের প্রয়োজন আছে বৈকি! আলবাত আছে!!!


 

ব্রহ্ম মুহূর্তে উঠলে ব্রহ্ম জ্ঞান হয়, এসব ভাবলে কাঁচকলা হয়! কিসের ব্রহ্মমুহূর্ত! ভারতে এখন যা সময়, আমেরিকায়ও কি তাই?তাহলে ভারতের জন্য ব্রহ্মমুহূর্ত আছে, আর যে আমেরিকায় বসে আছে তার জন্য ব্রহ্মমুহূর্ত নেই..??? এমন মুর্খের ভাবনা কখনো ভুলেও ভাবিস না!

 

তাহলে ভোরে উঠে কি হবে?

ভোরে এজন্য উঠতে বলছি, যাতে এই ভোরে উঠতে উঠতেই তোর শরীর মন শক্ত হয়ে যায়। যাতে কাজের চাপে দু'রাত না ঘুমালেও তোর শরীর সেটা হজম করে তোর সঙ্গ দেয়, তোর কাজের ব্যাঘাত না ঘটায়। আমার কথা শুনে যদি ভোরে উঠিস, তবে তোর অহংকারে বারবার আঘাত লাগবে আর এভাবেই তোর অজান্তেই তোর অহংকার কখন খসে যাবে, তা তুই জানতেও পারবি না।



যদি তোর এই নিয়ম মানতে অসুবিধা হয় তবে তুই স্বাধীন..

কিন্তু এই আশ্রম থাকতে হলে, এই নিয়ম তোকে মানতে হবে। ভেবে দ্যাখ, কি করবি!



অর্ণব তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই বললো,

ঠিক আছে আমি কাল থেকে ভোরেই উঠবো, সকলের সাথে বসে প্রার্থনাও করবো।

কিন্তু আমার ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না! আমাকে আমার মতো ছাড়তে হবে, আমি না উঠলে যেন আমাকে কখনো টার্গেট বানানো না হয়!

তবে আমি ১০০% চেষ্টা করবো, ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার।


তারপর থেকে... যিনি কখনো এই আশ্রমে সাতটার আগে সূর্যোদয় দেখেছেন বলে মনে করা যায় না, তিনিই নিয়মিত ভোর পাঁচটায় উঠে সকলের সাথে প্রার্থনায় বসেন।


পরে অর্ণব একদিন বলেছিল বটে! বাড়ি ফিরে গিয়ে কোন স্বার্থান্বেষী বসের কাছে মাথা ঝোঁকানোর  চেয়ে, মহারাজের কথা মেনে নিজের অহংকারকে তাঁর চরণে অর্পণ করার মধ্যে অনেক বেশি সম্মান রয়েছে..


সন্তানকে পিতা-মাতার এভাবেই পথ দেখানো উচিত। সন্তানের প্রতি, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দ্বিগুণ জোরে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়াও নয়, আবার সন্তানের প্রতি মোহ থেকে তার সব কথা মেনে নিয়ে তাকে অকর্মণ্য করে তোলাও নয়.. দুটোই সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।

তাই প্রথম থেকেই মোহ ত্যাগ করে সন্তানের জন্য মনে যদি তীব্র প্রেম রাখা যায়, তবে সন্তান ভুল পথে গেলেও তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনবার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।