February 02, 2022 - BY Admin

ভক্তির নামে জুয়াচুরি!

ভক্তির নামে জুয়াচুরি!


স্থান: দিয়াড়া আশ্রম

তারিখ: ০১.০২.২০২২


ব্রহ্মচারী রুদ্রজিত, বিখ্যাত তার ভয়ংকর রকমের কান ফাটানো হাসির জন্য! যদিও আশ্রমের সকলেই তাকে রুদ্র বলে জানে, তবে যেসকল ভক্ত আশ্রমে নিয়মিত আসেন, তারা প্রায় সকলেই তাকে পুরুত ব্রহ্মচারী বলেই মানেন।


কান্ড সে যা ঘটায় গোটা দিনে, তা গুণতিতে আনা বেজায় কঠিন! তবে নিত্যদিন তার এই হরেক রকমের কীর্তি দেখতে দেখতে আশ্রমের সকলেরই প্রায় হাসতে হাসতে দম ফাটবার জোগাড়!


এতদসত্ত্বেও এ কথা মানতেই হবে, তার মতো পুজোর জোগাড় সত্যি সত্যিই খুব কম পুরোহিতই করতে পারেন। এই কারণে আশ্রমের পূজার কাজের যতগুলি বিভাগ আছে, সবই তার করায়ত্ত! আশ্রমে যখন কোনো বিশেষ পূজা হয়, তখন তিনি পৌরহিত্য ছেড়ে ম্যানেজারির ভারটি নেন।

মানুষ হিসাবে ব্রহ্মচারী মহাশয় নিপাট সরল। তাই সকলে রাত দিন তাকে নিয়ে নানান কৌতুক করলেও, তিনি কিন্তু কক্ষণো এতটুকুও চটেন না। মহারাজের সাথে তার সম্পর্ক নেহাত আজকের নয়। হয়তো সেই কারণেই, এই সম্পর্কে একটা স্বাভাবিক সরলতা,সহজতা ও খুনসুটি প্রায়সই প্রকাশ পায়।

 

ব্রহ্মচারী মহাশয়ের কিম্ভুত কিমাকার কর্মের লিষ্টি থেকে কিছু নমুনা পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরবার চেষ্টা করা হলো (নিছক হাস্যরস প্রস্তুত করবার জন্য)। যেমন---

 

১) এক বাটি মুসুরির ডালে একটি আস্ত মোয়া মাখিয়ে তাতে একখানা গোটা পাতি লেবু চিপে, এক অদ্ভুত প্রকার পানীয় প্রস্তুত করে চোঁ চোঁ শব্দে এক নিমিষে সবটা মেরে দেওয়া..


২) বিষয় যাইই হোক, সকল বিষয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের প্রমাণ দিতে ভয়ংকর সব তথ্য এবং যুক্তি-ধারণার অবলম্বনের মাধ্যমে নিজেকে encyclopaedia প্রমাণ করবার সহস্রাধিক ব্যর্থ প্রয়াস করবার অতি বিশেষ ক্ষমতা বিধাতা পুরুষ একমাত্র তাকেই মুক্ত হস্তে দান করেছেন!


৩) যেভাবে একজন আম আদমি মুড়ির সাথে শসা, পেঁয়াজ মাখিয়ে খান... রুদ্র কিন্তু একেবারেই সেই পথ দিয়ে হাঁটেন না। তিনি উচ্চকোটির প্রতিভাধর প্রাণী বিশেষ। তাই তিনি শসা,পেঁয়াজ এর পরিবর্তে মুড়ির সাথে আপেল, কলা, কমলা, সন্দেশ ইত্যাদি সহকারে মেখে এক বিশেষ ধরনের অপ্রাকৃত মন্ড প্রস্তুত করেন, তারপর তা অতি শান্ত মেজাজে ধীর গতিতে গলধঃকরিত হয়!


এহেন ব্রহ্মচারী মহাশয় কোন এক রাত্রে স্বামীজীর 'জ্ঞানযোগ' পাঠ করতে বসিয়াছেন। তার ভয়ঙ্কর বিকৃত উচ্চারণের জ্বালায় ইতিমধ্যেই সমস্ত আশ্রমবাসী অত্তিষ্ঠ! মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে অনেকেরই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠিতে শুরু করেছে! 

কারণ, পাঠের অর্ধেক ভাষা বোঝা তো দূরস্থান, বক্তার অপূর্ব গুণময়তার মহিমায় পাঠের বিষয়বস্তু অবধি ধরতে পারা যায় না! তার এই নিদারুণ কাণ্ড দেখে মাঝে মধ্যে কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে ফিক্ ফিক্ করে হেসে নিচ্ছে...


এমন প্রকার ভয়ংকর পঠনের সমাপ্তি ঘটলে পর, মহারাজ এবার পাঠের ব্যাখ্যা শুরু করলেন। বিষয়, যাকে আমরা প্রেম বলি, তা কি আদৌ প্রেম?


মহারাজ: তোদের মধ্যে অনেকেরই একটা জায়গায় বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে! আগেও বলেছি, আবারও বলছি! যদি মনে জ্ঞানের আলো প্রবেশ না করে, তবে তোরা যাকে প্রেম বলছিস, তা কিছুতেই টিকবে না! এটা শুধু একটা আসক্তি হয়ে থেকে যাবে..স্বামীজীও এইখানে সেই কথাই বলছেন। আর জগতের ৯৯% মানুষ ঠিক এই ভুলটাই করছে! মোহ আসক্তিকে ভক্তি, প্রেমের নাম দিয়ে দিব্যি একটা বাজার খুলে বসেছে!


রুদ্রজিত: জগতের কথা ভেবে কি হবে মহারাজ! জগৎ তো মিথ্যা, কেবল ব্রহ্মই সত্য। ( এমন অদ্ভুত এবং অপ্রাসঙ্গিক যুক্তি শুনে সকলে একসাথে হো হো করে হেসে ওঠে)


মহারাজ: ভালো করে বোঝ! ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা মুখে বললে তো হবে না! এতই যখন বুঝিস, তখন পেটকে খেতে দিস কেন? মুখকে বলতে দিস কেন? ব্রহ্ম তো মৌন! তবে মৌন হয়ে যা।


রুদ্রজিত এতক্ষণে এক্কেবারে স্পিকটি নট্!


মহারাজ: প্র্যাকটিক্যাল বিষয়টা ধরবার চেষ্টা কর। 

যদি প্রেমকে বুঝতে হয়, তবে আগে নিজের মনের চোরামিগুলোকে identify করতে হবে। তার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন।পরিষ্কার ভাবে নিজের মনের চোরামিগুলোকে দেখে নে, এভাবেই জ্ঞান হয়।

আমরা সবাই ভালো করেই জানি আমাদের মনের ভিতরে কি চলছে! কিন্তু আমরা তা প্রকাশ তো করিই না, বরং এড়িয়ে যাই।

অন্যকে দোষী প্রমাণ করা বড্ড সোজা, কিন্তু  'আমি দোষী'--- এটা ভাবতে গেলেও অনেক বেগ পেতে হয়! কারণ জ্ঞান কঠোর।

 

ভক্তি বরং একটু soft বিষয়, তাই না?

তাই জগতের যাবতীয় নষ্টামি করেও আমরা নিজেদের ভক্ত বলে innocent প্রমাণ করবার চেষ্টা করি। যত রকমের কুকাজ আছে সব ঘটিয়ে বলে দিই, 'আমি আর কি করবো? সবই তার ইচ্ছা...' ইত্যাদি, ইত্যাদি! অথচ আমরা ভালো করেই জানি এই কাণ্ডটির পেছনে আমাদের ছাড়া আর কারো হাত নেই।


আর এই 'তার ইচ্ছার' নামেই জন্মাষ্টমীতে প্রভুর গালে কেক মাখানোর পর্ব চলে, গোপী সেজে নাচাগানা চলে! এভাবেই ভক্তির মত অতি উচ্চ ভাব বাজারি হয়ে যায়! 


বেসিক জিনিসটা বোঝ! বেদান্তের core সত্য না বুঝলে কখনোই জ্ঞান আসবে না.. আর জ্ঞান না এলে প্রেমও আসবে না। 

প্রেমের বদলে যা আসবে তার নাম আসক্তি, আর এই আসক্তি জীবনকে একেবারে ছারখার করে দেয়!এর থেকে তোরা বাঁচ!!!


সকলে এতক্ষন একমনে মহারাজের কথা শুনছিল..


হুঁশ ফিরলো, যখন সব শুনে রুদ্র হঠাৎ তার হেঁড়ে গলায় হি হি করে হাসতে হাসতে বললো, আচ্ছা প্রেমের কি সত্যিই কোন প্রয়োজন আছে?


মহারাজ তার দিকে একবার গোল গোল চোখ করে চেয়ে, আপাদমস্তক তাকে জরিপ করে নিলেন।


সকলে আবার একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো।