শিল্পই কি মুক্তি সাধন?
ভক্তসঙ্গ,
স্থান: অদ্বৈত জ্ঞানপীঠ, দিয়াড়া
তারিখ: ৫.০২.২০২২
সরস্বতী পূজা..
বীণাপাণির আহ্বানে আজ তাই গোটা আশ্রম আনন্দমুখর। মায়ের আরাধনায় এতটুকু ত্রুটি নেই কোন ক্ষেত্রে। উৎসবের সাত রাঙা আলোয় আশ্রম প্রাঙ্গণ ঝলমল করছে..
বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল আনুষ্ঠান পর্ব। একদিকে চলছে মন্ত্রোচ্চারণ, পূজা পাঠ, আর অন্যদিকে একইসাথে আশ্রম প্রাঙ্গণ মেতে উঠেছে নানান জমাটি অনুষ্ঠানে। ভক্তদের মধ্যে শিল্পীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শাস্ত্রীয় সংগীত, যন্ত্র সংগীত, বাউল গান, প্রার্থনা সংগীতে মুখর চারিদিক যেন এক পূর্ণ চন্দ্রের হাট। অপূর্ব পরিবেশ.. আশ্রমের প্রতিটি কোনা আলোকিত হয়ে রয়েছে সংগীতের আপন মাধুর্য ছটায়। এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে যেন মনে হয়, স্বর্গলোকের দ্বার আজ আপনা হতেই উন্মোচিত...
মহারাজ সবেমাত্র গান শেষ করে নিজের ঘরে এলেন, হয়তো একটু বিশ্রাম নেবেন। এরই মাঝে এক ভক্ত এসে জুটেছেন। অপেক্ষা করছেন তাঁরই জন্য..
ধন্য মহারাজ! উৎসবের সমগ্র আয়োজনের সামাল দিতে গিয়ে এ ক'দিন যাঁর বিশ্রামের এতটুকুও অবকাশ ছিল না, এমনকি কাল রাত অব্দি যিনি মাত্র দুই ঘন্টার বিশ্রামে, সকাল হতে আপন হস্তে আজ সর্ব দিকে সমান দৃষ্টি রেখেছেন.. তিনিই আবার যেন সমস্ত শারীরিক ক্লান্তিকে তুচ্ছ জেনে, ভক্তের আগ্রহে সর্বদা সমানাগ্রহী।
ইতিমধ্যেই , মহারাজ এসে পড়েছেন.. নানান আলোচনা চলছে। কথার পৃষ্ঠে কথা চেপে যেন এক বিরাট পর্বতশৃঙ্গের ন্যায় কথপোকথন চলছে।
ভক্ত স্বয়ং সংগীত বাদক। এক অসামান্য সুরঝংকারের শৃঙ্খলা আজ তার সরোদের প্রতিটি তারে খেলা করছিল। অত্যন্ত প্রতিভাবান তিনি। সর্বদা প্রশ্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেই বিশেষ ধারাই অব্যাহত রাখেন। আজও এরকমই নানা কথা হতে হতে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, "তাহলে মহারাজ আপনার কি বিচার, সংগীতের মধ্য দিয়ে আমরা কি ধীরে ধীরে মুক্তির পথে এগোতে পারি না?"
মহারাজ: না, একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ, মুক্তি আর সঙ্গীত-- এই দুটি এক বিষয় নয়। সঙ্গীত যদি ঘরের সিলিং হয়, মুক্তি তবে খোলা আকাশ। এবার আপনিই বলুন, ঘরের সিলিং যতই উঁচু হোক, তা কি কখনো আকাশের সমকক্ষ হতে পারে?
এমন বহু শিল্পীই আছেন যারা তাদের গোটা জীবনটাই সঙ্গীতকে উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু তারা কি প্রত্যেকেই মুক্ত
!!
যতক্ষণ না গান সত্যের প্রতি সমর্পণের জন্য গাওয়া হচ্ছে, যতক্ষণ না অব্দি গান থেকে আপনার কিছু পাওয়ার ইচ্ছা সম্পূর্ণভাবে চলে যাচ্ছে, ততক্ষণ গান মুক্তির সাধন হয় কিভাবে?
ধরুন, আপনাকে বলা হল.. আপনার এই দুটি হাত কেটে নেওয়া হবে। আপনি আর এই হাত দিয়ে কখনোই সরোদ ধরতে অব্দি পারবেন না.. পরিবর্তে এই শিল্পের প্রভূত উন্নতি হবে। কিন্তু আপনার দ্বারা আর কখনোই সরোদ বাজানো সম্ভব হবে না।
আপনিই বলুন,এসব জানবার পরও কি আপনি রাজি, যে হাত দিয়ে আপনি সরোদ ধরেন, সেই দুটি হাত কেটে ফেলে দিতে? যদি হন, তবেই মাত্র আপনি সমর্পিত। অন্যথায় আপনি যতই বলুন আপনি সংগীতের সাধনা করছেন, যতই গোটা জীবন শুধুমাত্র সঙ্গীত চর্চাই করে যান, যাইই করুন.. আপনি মুক্তিকামী নন! আপনি মুক্তির পথের পথিক হতে পারবেন না।
ভক্ত নিশ্চুপ!
মহারাজ: আপনি যা করছেন তা কেবল আপনার জন্যই করছেন। আপনার জন্যই আপনি সংগীতকে ভালোবাসেন! আপনি সঙ্গীতকে ভোগ করতে চাইছেন মাত্র। কিন্তু মুক্তির জন্য একে ভোগ নয়, এর হয়ে যেতে হয়..
যদি একথা মিথ্যা হতো, তবে শিল্পীর প্রচার পাবার কোন আশাই আর থাকত না!
ভীম সেন যোশী অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাঁকে কখনোই সাধক বলা যায় না.. তিনি মুক্ত এ কথা কি বলা যায়?
হ্যাঁ যখন মীরা গায়, যখন কবীর গান, যখন সুরদাস গায়... তখন তাঁদের গান অবশ্যই ভজন হয়ে যায়! কারণ তাঁরা সত্যের ভজনা করেন, তাঁরা সত্যের প্রতি সমর্পিত।
সত্যের সাথে শিল্পের কোথাও কোনো সংযোগ নেই। তবে এটা ঠিক যে আপনি সত্যের প্রতি সমর্পিত হয়ে আপনার আত্মিক গুণের, আপনার শিল্পের বিকাশ অবশ্যই ঘটাতে পারেন।
আপনি যখন এমন হয়ে যান যে এই শিল্প থেকে আপনার আর কোন চাওয়া-পাওয়া বেঁচে থাকে না, তখনই মাত্র আপনি সাধক। আপনার 'আমিত্ব', আপনার অহং কেবল তখনই শেষ হয়ে যায়, যখন আপনি সত্যের চরণে নিজেকে নিবেদন করেন।