সাধুর নিজের বলে কিছুই থাকতে নেই
স্থান: অহলদারা, সিটং
অহলদারাতে গিয়ে নিত্য দিন যা শিখেছি তা যতই লিখতে বসি, শেষ যেন আর হয় না। তারই থেকে কয়েকটা ছোট ছোট স্মৃতি ঝুলি থেকে বের করবার চেষ্টায় আজকের লিখতে বসা।
অহলদারায় আমাদের দ্বিতীয় দিন। সকাল বেলায় গাড়ি ভাড়া করে বেড়িয়েছিলাম ভিউ পয়েন্টের আশেপাশের আরো কিছু মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে।
সেখানের একটা ঘটনা, এমন আরও ঢের আছে!
আমি আগে থেকেই জানি, একটা বিষয় মহারাজের বেশ অপছন্দের। তা হল, নানান ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তোলা। তবুও, গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার দুপাশে পাইন গাছের ছায়া ঘেরা দৃশ্যে গা ভাসাতে না ভাসাতেই তাকে ঘিরে সকলের ছবি তোলার ধুম শুরু। গাড়ি থেকে নামতে নামতে দেখলাম পাশ দিয়ে এক ভক্ত প্রায় ছুটতে ছুটতে গেলেন, গুরুদেবের একখানি ছবি পাওয়ার অভিলাষে। দৃশ্যটা দেখতে এমন মজার লাগছিল, যে বলেই ফেললাম, ঠিক যেন মডেল। সবাই মিলে ঘিরে ফটো তুলছে!
মহারাজ গম্ভীর স্বরে বললেন, জানো তো এই কাজটাকে আমি কতটা অপছন্দ করি!
মুখে বললাম, জানি মহারাজ। মনে মনে শ্রদ্ধার পারদ আরও একটু চড়ে গেল। মনে পড়ে গেল মহারাজের বলা সেই কথাটা..
"সাধুর নিজের বলে কিছুই থাকতে নেই।"
ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দকে শিকেয় তুলে দিতে তাঁর একটুও আপত্তি দেখিনি কখনো। আজও এর ব্যতিক্রম দেখলাম না।
রাতে দেখলাম মাইগ্রেনের ব্যাথা নিয়ে ভক্তদের অনুরোধে মহারাজ গেয়ে চলেছেন একের পর এক গান। গান শেষ হতেই আবার দু'একজন ভক্ত ঘিরে ধরল। দৃশ্য দেখে একটু রাগই হল প্রথমটায় আমার। কিন্তু মাইগ্রেনের পেইন নিয়েও মহারাজের মুখে অমন স্নিগ্ধতা আর চিত্তে অমন প্রশান্ততা আর সকলকে দেওয়া একের পর এক উপদেশের ঢল, আমার মন ভরিয়ে দিল। আমিও ডুবে গেলাম এই আনন্দসাগরে। মনে হল যেন বেদান্তের প্র্যাক্টিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন দেখছি।
পর দিন সকালে অহলদারা থেকে আমাদের ফেরবার পালা। গরম গরম লুচি দিয়ে সকাল সকাল সকলের ব্রেকফাস্ট এক্কেবারে কমপ্লিট। বাকি শুধু একটি প্রাণ। ফেরবার আগে সকল ভক্তদের নিয়ে একটা ছোট্ট সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হয়েছে। ভক্তদের দাবি মহারাজকে আজও গান গাইতে হবে। দাবি মেটাতে মহারাজ সকাল থেকে না খেয়ে বসে। ভরা পেটে নাকি ভালো গান গাওয়া যায় না। আমি বললাম, খেয়ে নিন তো, গান গেয়ে আর কাজ নেই। উত্তর এলো না কিছু। ঠায়ে বসে রইলেন। কবীরজীর গান ধরলেন, 'মোকো কাঁহা ঢুন্দে রে বান্দে!'
আহাঃ! কি মিষ্টি সেই গান! শুনে, প্রাণ জুড়িয়ে গেলো.. তক্ষুণি জানলা দিয়ে দেখলাম এক রাশ মেঘ ভেসে গেল। সকলে ডুবে গেলাম সেই অথৈসাগরে।
এরপর ঘরময় এক অপার্থিব শন্ততা। সকলে একেবারে চুপ.. কি গানটাই না গাইলেন আজ মহারাজ।
স্বামীজির কর্মযোগ আমার বড় প্রিয়। সেখানে এক স্থানে স্বামীজি বলছেন, কাউকে বিচার করতে হলে তাঁর করা ছোট ছোট কাজ দিয়ে বিচার কর, দেখ কত নিখুঁত ভাবে সে কাজ করছে। বড় কাজে বীরত্ব দেখাতে সবাই পারে। ছোট ছোট কাজগুলো দেখ, এতেই বুঝবে কার চরিত্র কত মহান।
এত বড় ক্ষমতা আমার নেই, যে আমি মহারাজের কাজের মাপ ঝোপ করব। শুধু তাঁকে দেখে বারবার এইটুকু শিখি, যে সাধুর নিজের বলে কিছুই থাকতে নেই!